গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, ত্রিপুরার গোমতী নদীর উপর স্থাপিত ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে ফেনীর মুহুরী নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। এ তথ্যটি অনেকেই বিশ্বাস করেছেন এবং এর ফলে ফেনীসহ আশপাশের অঞ্চলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে এই তথ্যটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং গুজবের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আজ আমরা এই ভুল ধারণার পেছনের বাস্তব কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখব।
ডম্বুর বাঁধের অবস্থান ও কার্যকারিতা
ত্রিপুরার গোমতী নদীর উপরে অবস্থিত ডম্বুর বাঁধটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার হিসেবে কাজ করে। এটি গোমতী নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং ত্রিপুরার মধ্যে বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করে। তবে ডম্বুর বাঁধের অবস্থান এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা প্রয়োজন। এই বাঁধ খুলে দিলে গোমতী নদীর পানি ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা জেলার মেঘনা নদীতে মিশে যায়। অর্থাৎ, ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে ফেনী জেলার মুহুরী নদীর সাথে কোনো ধরনের সংযোগ বা সম্পর্ক তৈরি হয় না।
গোমতী নদী এবং মুহুরী নদী দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জলপ্রবাহ সিস্টেমের অংশ। গোমতী নদী ত্রিপুরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং কুমিল্লা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে, মুহুরী নদী ফেনী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। গোমতী নদীর পানি কোনভাবেই মুহুরী নদীর সাথে মিশতে পারে না। সুতরাং, ডম্বুর বাঁধের পানির ফেনীর মুহুরী নদীতে বন্যা সৃষ্টি করার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই।
ফেনীতে বন্যার প্রকৃত কারণ
ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়ার মূল কারণ হলো প্রবল বৃষ্টিপাত। গত কয়েক দিন ধরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে মুহুরী নদীর পানির স্তর বেড়ে গেছে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ১৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ফেনীর পরশুরামে ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া খাগড়াছড়ির রামগড়ে ১৪৫ মিলিমিটার, নোয়াখালীতে ১৫৪ মিলিমিটার, কুমিল্লায় ২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এই অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণেই মুহুরী নদী এবং ফেনী জেলার বিভিন্ন অংশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ত্রিপুরার বৃষ্টিপাতের প্রভাব
ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা ফেনী জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রভাব ফেলেছে। ত্রিপুরার আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ আগস্ট বাগাফায় সর্বোচ্চ ৩৭৫ মিলিমিটার এবং বিলোনিয়ায় ৩২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই অতিভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ত্রিপুরার বিভিন্ন নদী দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তবে, এ বৃষ্টিপাত মূলত ত্রিপুরার মধ্যাঞ্চল এবং গোমতী নদীর বেসিন এলাকায় ঘটেছে। গোমতী নদীর পানি ফেনী নদী বা মুহুরী নদীর সাথে কোনোভাবেই মিশতে পারে না। ফলে এই অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কারণ ডম্বুর বাঁধ খোলা নয় বরং প্রচুর বৃষ্টিপাত।
সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের প্রসার
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। ডম্বুর বাঁধ খোলার ফলে ফেনী জেলার মুহুরী নদীতে বন্যা হয়েছে বলে প্রচারিত তথ্যটি এরই একটি উদাহরণ। বাংলাদেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলো এ ধরনের ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার না করলেও, ফেসবুকে তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
এই ভুল ধারণাটি স্পষ্ট করার জন্য বলতে হয়, ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে ফেনী জেলার বন্যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বরং, বন্যার মূল কারণ হলো অতি ভারী বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঢলের পানি। বিশেষ করে ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ এবং মধ্যাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায়, ত্রিপুরার নদীগুলোর পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেখান থেকে পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত মিথ্যা তথ্যের কারণে ফেনী জেলার মানুষ যে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে, তা অনভিপ্রেত। সাধারণ মানুষের উচিত যে কোনো তথ্য যাচাই করে বিশ্বাস করা এবং সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকা। ফেনী জেলার বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি ডম্বুর বাঁধ খোলার কারণে সৃষ্টি হয়নি, বরং প্রাকৃতিক কারণেই এ বন্যা দেখা দিয়েছে। তাই, সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রকৃত তথ্য যাচাই করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। সঠিক তথ্য জানতে নিয়মিত ভিজিট করুন।